বাংলাদেশের রাজনীতিতে অস্থিরতা নতুন কিছু নয়। দেশের রাজনীতি উদ্বেগজনক মাত্রায় ঘোলাটে হয়ে পড়েছে। আর এ ক্ষেত্রে অভিযোগ পরিকল্পিতভাবেই তা করা হয়েছে। এর মানে, কোনো না কোনো পক্ষ এই ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে চাইছে। সম্প্রতি যেসব ঘটনা ঘটছে, তাতে মানুষের মনে নানা উদ্বেগ, অজানা আশঙ্কা ও ভয়ের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। তবে গত বছরের জুলাই মাসের গণ-অভ্যুত্থানের পর থেকে যে ধরনের রাজনৈতিক পুনর্গঠন ও শক্তির পুনর্বিন্যাস শুরু হয়েছে, তা এখন ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে। দীর্ঘ সময় ধরে একচ্ছত্র ক্ষমতা উপভোগকারী একটি সরকারের পতনের পর নতুন নেতৃত্ব, নতুন পথ এবং নতুন রাজনৈতিক বিন্যাস নিয়ে মানুষের প্রত্যাশা অনেক। এ প্রেক্ষাপটে তিনটি ভিন্ন রাজনৈতিক দল মাঠে সরগম রয়েছে। এই দলগুল হল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল ( বিএনপি), বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী (জামাত),জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। কিন্ত এখন প্রশ্ন এই সব রাজনৈতিক দল গুলির মধ্যে কেন ঐক্য নেই। যদিও জামায়াতে ইসলামি ও জাতীয় নাগরিক পার্টি বা এনসিপি নিজেদের মধ্যে কিছুট হলেও ঐক্যের লক্ষ করা যাচ্ছে। পেক্ষাপট দেখে মনে হয় তারা বিএনপির প্রতিপক্ষ হিসাবে কাজ করছে। গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গঠিত বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার যে মাত্রায় জনসমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় বসেছে, তার নজির বাংলাদেশে নেই। পতিত ও পরাজিত পক্ষ ছাড়া দেশের সব রাজনৈতিক দল এই সরকারের প্রতি তাদের সমর্থন জানিয়েছে। তাহলে কেন সরকার দেশের সন্ত্রাস বা চক্রান্তকারীদের নির্মূল করতে পারছে না ? দেশজুড়ে সহিংসতা উদ্বেগজনকভাবে কেন বৃদ্ধি পাচ্ছে? কেন গড়ে প্রতিদিন প্রায় ১১টি জীবনহানির ঘটনা ঘটবে? এ প্রশ্ন শুধু আমার নয় সর্ব সাধারনের। সরকারকে মনে রাখতে হবে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা জাতীয় ঐক্য যেন বিনষ্ট না হয়। তা বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতা এবং ভবিষ্যতের সম্ভাব্য গতিপথ বোঝার জন্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। বাংলাদেশের চলমান রাজনীতিতে যে অস্থিরতা বিরাজ করছে, তা সমাধানের একমাত্র পথ হচ্ছে রাজনৈতিক ঐক্য। আমাদের মনে রাখতে হবে, মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত বাংলাদেশের অঙ্গীকার ছিল সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা কিন্ত আজও তা দেশে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। আমরা দেখেছি নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে তিন জোটের যে রূপরেখা প্রণীত হয়েছিল, তা পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক অনৈক্যের কারণে বাস্তবায়ন করতে ব্যর্থ হয়েছে। ফলে চব্বিশের জুলাই মাসে ছাত্র-জনতার রক্তাক্ত গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছে। ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতা এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে একটি জাতীয় ঐক্য গড়ে উঠার প্রয়োজন ছিল। এখন সময় এসেছে দেশ গড়ার কাজে তারুণ্যের এই শক্তিকে কাজে লাগাতে হবে।গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে যে সরকার প্রতিষ্ঠা হয়েছে, তাদের প্রধান কাজ রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান করা। গণঅভ্যুত্থানে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলো সংস্কারের যে আকাঙ্ক্ষা জনগণের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে, তা উপেক্ষা করার কোনো সুযোগ নেই। ফলে সরকারকে দক্ষতার সঙ্গে বিষয়গুলো সমাধানের জন্য জরুরি পদক্ষেপ নিতে হবে। রাজধানীর মিডফোর্ট হাসপাতালের সামনে জাহিলিয়াত যুগের মত ব্যাবসায়ী সোহাগ কে হত্যা এবং গোপালগজ্ঞে যে ঘটনা ঘটে গেল আসলে এটা কারো কাম্য নয়। গণ-অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতনের পর রাজনৈতিকভাবে বাংলাদেশ সম্ভবত সবচেয়ে জটিল ও কঠিন সময় পার করছে। বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকার বা সেনাবাহিনী নিয়ে প্রচারিত ও প্রকাশিত নানা মন্তব্য ও মতামত দেশে অস্থিরতার পরিবেশ তৈরি করেছে। জুলাই গণ-অভ্যুত্থান মতপ্রকাশের বন্ধ দরজার অর্গল ভেঙে দিয়েছে। বর্তমান মুক্ত পরিবেশে সত্য, অসত্য, উদ্দেশ্যমূলক বা বিভ্রান্তিকর কোনো মত বা তথ্যের প্রকাশ ঠেকানোর সুযোগ নেই। অনেকে বলছেন অন্তর্বর্তী সরকার গত ১০ মাস ভালোভাবে দেশ পরিচালনা করতে পারছে না । বরং অনেক ক্ষেত্রে অদক্ষতা, সিদ্ধান্তহীনতা বা কিছু বিষয়ে জোরালো অবস্থান গ্রহণে ব্যর্থতার দিকই স্পষ্ট হয়েছে। দেশে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড বৃদ্ধির প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে, বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন এবং সাধারণ মানুষের কাছ থেকে এমন উদ্বেগের কথা শোনা যাচ্ছে। পুলিশের অপরাধ বিষয়ক পরিসংখ্যানও এই প্রবণতাকে সমর্থন করে। বিশেষ করে, রাজনৈতিক অস্থিরতা, অর্থনৈতিক বৈষম্য, দারিদ্র্য, বেকারত্ব, এবং শিক্ষার অভাব – এই বিষয়গুলো অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছে। এছাড়াও, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অপব্যবহার, মাদকাসক্তি, এবং সাইবার অপরাধের মতো বিষয়গুলোও উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে, অপরাধের ধরণ পরিবর্তন হচ্ছে এবং নতুন নতুন অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, সাইবার অপরাধ, আর্থিক জালিয়াতি, এবং কিশোর অপরাধের মতো বিষয়গুলো সাম্প্রতিক সময়ে বেশি দেখা যাচ্ছে। সরকার এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতে যেন হিমশিম খাচ্ছে। তবে আমি মনে করি অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আনতে হলে সমাজের সর্বস্তরের মানুষের সহযোগিতা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে, সচেতনতা বৃদ্ধি, শিক্ষার প্রসার, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, এবং সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা জরুরি। চলতি বছরে বাংলাদেশে অপরাধের ঘটনা তীব্রভাবে বাড়ছে—এমন দাবি পরিসংখ্যানগতভাবে পুরোপুরি সঠিক নয় বলে জানিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। প্রধান উপদেষ্টার উপ-প্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ মজুমদার বলেন, ‘গত ১০ মাসে বড় অপরাধের ক্ষেত্রে স্থিতিশীলতার প্রবণতাই দেখা যাচ্ছে। তিনি পুলিশের সদর দপ্তরের পরিসংখ্যান উল্লেখ করে এ মন্তব্য করেন।উপ-প্রেস সচিব বলেন, সম্প্রতি বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে অপরাধ বৃদ্ধির প্রবণতা তুলে ধরা হয়েছে, যা নাগরিকদের মধ্যে উদ্বেগ ও নিরাপত্তাহীনতার অনুভূতি সৃষ্টি করছে। সে যায় হোক সকলে মনে করছেন এর জন্য দায়ী রাজনৈতিক অস্থিরতা। কয়েক মাস আগে পদত্যাগ করতে চেয়ে ছিলেন? কেহ কি ভেবে দেখেছেন? বর্তমানে সংস্কার প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলোর অনৈক্য ছাড়াও একটা বড় সমস্যা। দেখছি প্রতিনিয়ত সংস্কার কমিশন দলগুলি নিয়ে আলোচনা করছে। জামাত কেন সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলছে। বিএনপির কেন সরকারের প্রতি আস্থা নেই। এনসিপি কেন বার বার সরকারকে হুমকী দিচ্ছে।কেন এমন হবে এই সরকারকে তো তারাই বসিয়ে ছিলেন।বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান কে নিয়ে কুরুচিপূর্ণ স্লোগান বা বক্তব্য দেওয়া হচ্ছে। এ সব কিসের লক্ষন। এমনি চলতে থাকলে আবাও অনেক বড়ধরনের খেসারত দিতে হবে জাতিকে। অন্তর্বর্তী সরকার এক দলকে কোলে আরেক দলকে কাঁধে রেখেছে বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস। দেশের চলমান পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে মির্জা আব্বাস বলেন, জুলাই আন্দোলনের শহীদদের বিক্রি করে কেউ কেউ রাজনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার চেষ্টা করছে।শহীদদের নিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য চলছে, রাজনৈতিক ব্যবসা চলছে। তারা বেঁচে থাকলে লজ্জা পেতেন। তারা যে কারণে জান দিয়েছিল, যে কারণে গুলির সামনে বুক পেতে দিয়েছিল, সেই কারণগুলো আজকে হচ্ছে না। এছাড়া বিএনপির নেতারা মনে করছেন,ষড়যন্ত্র করে চোরাই পথে কেউ কেউ আগামীতে ক্ষমতায় আসার চেষ্টা করছে। এদিকে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির সাবেক এমপি ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেছেন, বাংলাদেশের মানুষ শঙ্কিত নয়, উদ্বিগ্ন। হাজার-হাজার ছাত্র-জনতার জীবন ও রক্তের বিনিময়ে অর্জিত নতুন বাংলাদেশ। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দুর্বলতা ও সিদ্ধান্তহীনতায় মনে হয় সরকারের সাথে গোপন কোন শক্তি কাজ করছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, গোপালগঞ্জের ঘটনায় স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার সঙ্গে কথা বলে মনে হয়েছে, তিনি খুবই অসহায়। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেছেন, ‘প্রশাসনের কোন দুর্বলতা থাকলে তিনি ব্যবস্থা নিবেন।ডা. তাহের বলেন, আমাদের মনে হয়, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা নিজেই দুর্বল ও অসহায়। যার বাস্তবতা রাষ্ট্রের সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে ফুটে উঠেছে। মিটফোর্ডের ঘটনা থেকেই গোপালগঞ্জের ঘটনার সাহস দেখিয়েছে পতিত আওয়ামী লীগের দোসররা। আমরা অনতিবিলম্বে ‘মিস্টার অসহায়’ স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাকে প্রত্যাহার করতে সরকারের কাছে জোর দাবি জানাচ্ছি। জুলাই সনদ ঘোষণা দিতে সরকার ‘ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে’ বলে অভিযোগ করেছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম। এ ছাড়া এনসিপির নেতৃবৃন্দ সবসময় সরকার কে হুমকী দিয়ে চলেছে। দেশে একের পর এক ‘মব ভায়োলেন্স’ বা ‘দলবদ্ধ বিশৃঙ্খলা’দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রকাশ্যে নৃশংস হত্যাকান্ড ও ছিনতাইয়ের ঘটনায় জনমনে আতঙ্ক বা ভয়ের পরিবেশ তৈরি হচ্ছে। পাথরে শরীর থেঁতলে দেওয়া, প্রকাশ্যে পিটিয়ে হত্যা কিংবা রাজপথে অস্ত্র ঠেকিয়ে অর্থের পাশাপাশি জামা-জুতা পর্যন্ত ছিনিয়ে নেওয়া সাধারণ মানুষের মধ্যে নতুন আতঙ্কের জন্ম দিয়েছে। এ ছাড়া মাদক ও পারিবারিক বিরোধেও হত্যাসহ নৃশংস অপরাধ ঘটছে। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজনৈতিক প্রভাব আর মাঠ পুলিশের নিষ্ক্রিয়তায় লোমহর্ষক অপরাধ ভয় জাগাচ্ছে। যদিও সরকারের প্রেস উইং থেকে বলা হয়েছে, দেশে বড় ধরনের সহিংস অপরাধ বাড়েনি। তবে আমি বলবো ভবিষ্যতের সম্ভাব্য গতিপথ বোঝার জন্য সকলকে সজাগ থাকতে হবে এবং সকল রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে ঐক্যমত গড়ে তুলতে হবে।
লেখক ও গবেষক
আওরঙ্গজেব কামাল
সভাপতি : ঢাকা প্রেস ক্লাব