হাওরাঞ্চলের প্রায় সব ইটভাটা চলে অবৈধ উপায়ে, মৌসুমে দাদনেও মালিকপক্ষ কিনে স্বস্তায় শ্রম। শ্রম বেচাকেনার অনিয়মেও দেখা দেয় বিশৃংখলা। নিম্নমানের কয়লার পাশাপাশি হচ্ছে লাকড়ির ব্যবহার, হচ্ছে পরিবেশ বিপন্ন। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে স্বাস্থ্য ঝুঁকিও। তদারকির দায়িত্ব থাকাদের পাশাপাশি স্থানীয় প্রশাসনের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।কিশোরগঞ্জের নিকলীতে অসংখ্য ইটভাটায় কৌশলিক কায়দায় মালিকেরা কিনে থাকে হতদরিদ্রের কাছে থেকে দাদনে স্বস্তার শ্রম। এমন কঠিন বাস্তবতা শুধু অত্র এলাকার ইটভাটাতেই নয় বরং সারা দেশেই টুকিটাকি এমন তথ্য উঠে আসে। অভাবের তাড়নায় স্বস্তায় শ্রম বিক্রি করে বিপাকেও পড়ে অনেকেই।
এসব এলাকার প্রভাবশালী মালিকদের কাছে আইন যেনো অনেকটাই তাদের পকেটে। রাজনৈতিক সুবিধাভোগী নেতারাও করে থাকে অবৈধ সুপারিশ।
বর্ষার পানি শুকাতেই কিশোরগঞ্জের নিকলী ও বাজিতপুরসহ হাওরাঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে ইট তৈরির প্রস্তুতি চলছে। কোথাও কোথাও কার্যক্রমও শুরু হয়ে গেছে। তবে পরিবেশ অধিদপ্তরের কিশোরগঞ্জ শাখার তথ্যমতে, জেলার ১১৩টি ইটার মধ্যে ৩৭টি ইটভাটাই অবৈধ। যদিও এই তথ্যে দেখা দিয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। একাধিক সূত্রে জানা গেছে মোট ইটভাটার সংখ্যা আরো অধিক হতে পারে। তাছাড়াও অবৈধ কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে এমন ইটভাটার সংখ্যাও অনেকাংশে বেশি। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের মতে,কালো ধোঁয়ার ফলে বাড়ছে স্বাস্থ্য ঝুঁকি।
স্থানীয় সচেতন মহলের অভিযোগের ভাষ্য, পরিবেশ অধিদপ্তর বলছে তাদের কার্যক্রমের কোনো বৈধতা নেই। অথচ চলমান রয়েছে কার্যক্রম। প্রশ্ন উঠেছে এসব কি ক্ষমতার দাপটে, নাকি প্রশাসন ম্যানেজ করে।
খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে নিকলী উপজেলার সকল ইটভাটার বিরুদ্ধেই সীমাহীন অভিযোগ রয়েছে। স্থানীয় পর্যায়ে মানববন্ধন থেকে শুরু করে প্রশাসনের উপর মহলের বিভিন্ন দপ্তরে মিলেছে লিখিত অভিযোগের তথ্য। এসবের পরেও যুগ যুগ ধরে চালিয়ে যাচ্ছে নিয়ম বহির্ভূতভাবে। এমন দৃশ্যে মনে হয় যেনো এসব অঞ্চলে আইন একেবারেই অন্ধের ভূমিকায়! মালিক পক্ষের লোকেরা রাজনৈতিক দলের নেতাদের অনৈতিক সুপারিশের পাশাপাশি অর্থনৈতিক সুবিধা দিয়েও ইটভাটা কার্যক্রম চালিয়ে থাকে বলে গুঞ্জন রয়েছে। অনুসন্ধানে দেখা গেছে অধিকাংশ ইটভাটা এখনও কৌশলিক কায়দায় ফ্যাসিস্টরা চালিয়ে যাচ্ছে।
যখন যেই দলের প্রভাব থাকে, তখন সেই দলের নেতাদেরকেই মালিকপক্ষ কাজে লাগায় এমন বাস্তবতাও রয়েছে। যে কারণে অভিযোগেও থেমে নেই অবৈধ ইটভাটার কার্যক্রম।
পরিবেশ অধিদপ্তরের দেয়া তথ্যমতে নিকলী ও বাজিতপুরে ১৫ টি ইটভাটা থাকলেও সেখানে ৪টি ইটভাটা পরিবেশ অধিদপ্তরের নিয়ম মেন চলছে বলে পরিবেশ অধিদপ্তর স্বীকার করে। তবে বাকীরা একে বারেই নিয়মবহির্ভূত। এখানকার ফসলিজমি, রাস্তা ও গাঁয়ের পাশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, গুরুত্বপূর্ণ হাটবাজার ও পর্যটন এলাকার রাস্তা ঘেঁষেই অধিকাংশ ইট ভাটা স্থাপন করা হয়েছে। এমনকি মাছের অভয়াশ্রমের পাশেও দেখা মিলে এসকল পরিবেশ দূষণকারী ইটভাটা। টপ সয়েল বিষয়েও রয়েছে অভিযোগ। এতদ্বসত্ত্বেও প্রশাসন যেনো দেখেও তা দেখে না। এমন অভিযোগ সচেতন মহলের। সরেজমিনে নিকলী উপজেলার আলতাফ ব্রিক, কামাল ব্রিক, ও সামিহা ব্রিক ফিল্ড সহ পাশ্ববর্তী কটিয়াদী করগাঁও এর শাপলা ব্রিক একই পরিবারের আর অধিকাংশ যৌথ মালিকানায় স্থাপিত। এর সবকটিই অবৈধ। ছাড়াও বাজিতপুর উপজেলার বিভিন্ন স্থানের ১২ টি ইটভাটার মধ্যে মধ্যে ৮টিই অবৈধ। এসব অবৈধ ইটভাটায় নিন্ম মানের কয়লার পাশাপাশি মাঝে মাঝে লাকড়ির ব্যবহার করে থাকে। ফলে নির্গত হয় কালো ধোঁয়া, বাড়ছে পরিবেশ দূষণ, বাড়ছে শিশুসহ বয়োবৃদ্ধদের শ্বাস-প্রশ্বাস জনীত রোগ। সেক্ষেত্রে জেলা সিভিল সার্জন ডা.অভিজিত শর্ম্মার সাথে কথা হলে ইটভাটার কালো ধোঁয়ার কুফলে শ্বাসতন্ত্রের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়, ঘন ঘন শ্বাসনালীতে ইনফেকশন দেখা দেয়, শ্বাসকষ্টজনিত রোগের পাশাপাশি দীর্ঘদিন এই অবস্থা বিরাজ করলে এক কথায় ক্যান্সারে আক্রান্তের ঝুঁকি বেশি থাকে বলেও উল্লেখ করেন।
অনুসন্ধানে উঠে আসে জনস্বাস্থ্য সচেতনতার পাশাপাশি পরিবেশের দিক বিবেচনায় একাধিক সময়ে উল্লেখ করা হয় পরিবেশ বান্ধব বৈদ্যুতিক ইটভাটা স্থাপনের বিষয়েও। সেই সাথে অধিক গুরুত্বের বিষয় তুলে ধরা হয় জনস্বার্থ বিবেচনায়। ২০২৫ সালের মধ্যে শতভাগ ব্লকের ব্যবহার নিশ্চিতকরণের বিষয়েও নানামুখী আলোচনা হয়। তৎসত্ত্বেও শতভাগ কার্যকরী ফলপ্রসূ ভূমিকা না থাকায় সচেতন মহল সংশ্লিষ্ট বিষয়ের তদারকির অভাবের পাশাপাশি প্রশাসনিক দুর্বলতাকেই দায়ী বলে অভিহিত করেন।
নিকলী থানার অফিসার ইনচার্জ কাজী আরিফ উদ্দিন এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, হাজী রূপালি ইটভাটায় দাদনে শ্রম দেওয়ার পরে দুইজনের বিরুদ্ধে থানায় গত সিজনে মামলাও করতে এসেছিলেন। এছাড়াও ওসি আরও উল্লেখ করেন, বিবাদীদের ভাষ্যমতে, শ্রম দিয়ে অনেকখানি পরিশোধ করলেও রূপালী নাকি তাদেরকে আইনগতভাবে ফাঁসানোর চেষ্টা চালিয়ে বেড়াচ্ছেন। বিষয়টি নিয়ে তাকেও অনেকখানি বিভ্রান্তি পোহাতে হয়েছে বলে উল্লেখ করেন।
আলতাফ ব্রিক ফিল্ডের অংশীদার থানা আওয়ামীগ উপদেষ্টা হাজী রূপালি মিয়ার সাথে ৫ নভেম্বর ৩ টা বাজে ১০মিনিটে তার ব্যক্তিগত এই ০১৭১০০৯৩৮৯৬ নম্বারে কথা হলে তিনি দম্ভের সাথে জানান, সারা দেশের সকল ইটভাটাই অবৈধভাবে চলে, শুধু তারটা নয়। তাছাড়াও দাদনের কথা প্রসঙ্গে ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকা দাদন দিয়েন থাকেন বলে উল্লেখ করেন।
নিকলী উপজেলা সদরের ৪নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য নজরুল ইসলাম, ৮নং ওয়ার্ডের আনিসুজ্জামান মোহন, ৫ নং ওয়ার্ডের সাবেক ইউপি সদস্য ও বিএনপি নেতা শাহার উদ্দিন এবং থানা বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মহিউদ্দিন, এমনকি বিএনপি নেতা নজরুল ইসলামসহ অনেকেই জানান, দাদনে শ্রম কেনাবেচার ফলে বিশৃংখলার সৃষ্টি হয়ে থাকে। বিশেষ করে হাজী রূপালি গত মৌসুমেও একাধিক শ্রমিককে এ নিয়ে বেকায়দায় ফেলেন। এসব ঘটনায় থানাতেও আপোষ মিমাংসার লক্ষ্যে একাধিকবার চেষ্টা চালানো হয়েছে বলে জানান।
কামাল ব্রিক ফিল্ডের মালিকের মালিক কামালকে তার ব্যক্তিগত ০১৭১১০৬২১৮৩ নম্বরে ৯ সেপ্টেম্বর বেলা সোয়া ১২ টার দিকে ফোন করা হলে সাংবাদিক পরিচয় দিতেই ইটভাটা মালিক পরিচয় গোপন রাখে। এক পর্যায়ে তথ্য এড়িয়ে যেতে আলতাফ ব্রিকের মালিককের হাতে ফোন তুলে দেন। অবৈধ ইটভাটা কিভাবে চালাচ্ছেন? এমন প্রশ্নে নিকলীতে আরো ১০ জন সাংবাদিক আছে তারাতো এ নিয়ে লেখালেখি করে না! এমন কথায় প্রাসঙ্গিক তথ্য এড়িয়ে যান।
বাজিতপুর উপজেলা ইটভাটা মালিক সমিতির সভাপতি ও উলাইয়া ব্রিকের মালিক খালেকুজ্জামানের ০১৭১২ ৫২৬২৩৬ নাম্বারে ৯ নভেম্বর একাধিকবার চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি।
কিশোরগঞ্জে পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মমিন ভূঁইয়ার সাথে নিকলী বাজিতপুরের অবৈধ ইটভাটার বিষয়ে কথা হলে নিকলীর সবক’টি ইটভাটা অবৈধ বলে জানান। পাশাপাশি বাজিতপুরের ১২টির মধ্যে শুধু ৪টি পরিবেশ অধিদপ্তরের নিয়মের মধ্যে চলছে বলে উল্লেখ করেন। তাছাড়া বাকী সব কয়টিই অবৈধ বলে জানান।
জেলা প্রশাসক ফৌজিয়া খানের সাথে
নিকলীতে অবৈধ ইটভাটা কার্যক্রমে নেপথ্যে থাকা বহিরাগত জামায়াত নেতার সুপারিশ প্রসঙ্গে কথা হয়। ফ্যাসিস্ট মালিকদের পাশাপাশি কথা হয় সেখানে স্বস্তায় দাদনে শ্রম কেনার বিষয়ে। সার্বিক দিকসহ সেখানকার ইটভাটার বিষয়ে গভীরভাবে অনুসন্ধান চালাবেন বলে উল্লেখ করেন।
উপদেষ্টা: এ্যাড. এনামুল হক এনাম সম্পাদক : মোঃ শামীম আহমেদ অফিসঃ ১৫০ নাহার ম্যানসন (৫ম তলা) মতিঝিল বানিজ্যিক এলাকা,ঢাকা -১০০০। খন্দকার এন্টারপ্রাইজ লি. এর পক্ষে কেএম সবুজ কর্তৃক প্রকাশিত। মোবাইল নং : ০১৭১৫-৬২৭৮৯৪ , ০১৭৮৪-৮৩৮৬৮০ ই-মেইল: news@dhakabani.com
প্রকাশিত সংবাদপত্রের অংশ