
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোটের তপশিল ঘোষণার পরদিন রাজধানীতে ঘটে যাওয়া গুলির ঘটনায় দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে তীব্র উদ্বেগ ও উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে রাজধানীর বিজয়নগরে ঢাকা-৮ আসনের সম্ভাব্য স্বতন্ত্র প্রার্থী ও ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদির ওপর গুলিবর্ষণের ঘটনাকে কেন্দ্র করে উদ্ভূত সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠকে বসেছে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী এবং জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)।
শনিবার সকাল সোয়া ১১টার দিকে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় এ গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক শুরু হয়। বৈঠকে তিনটি রাজনৈতিক দল থেকে দুজন করে প্রতিনিধি অংশ নেন, যা চলমান রাজনৈতিক সংকট ও নির্বাচনকালীন নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে দলগুলোর উদ্বেগের প্রতিফলন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বিএনপির প্রতিনিধি দলে ছিলেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ এবং অবসরপ্রাপ্ত মেজর হাফিজ উদ্দিন আহমেদ। জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে বৈঠকে অংশ নেন দলের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার এবং সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এহসানুল মাহবুব জুবায়ের। জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) প্রতিনিধি দলে ছিলেন দলটির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম এবং মুখ্য সংগঠক (দক্ষিণাঞ্চল) হাসনাত আবদুল্লাহ।
উল্লেখ্য, শরিফ ওসমান হাদির ওপর গুলিবর্ষণের ঘটনার দিন শুক্রবারই প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় এক জরুরি বৈঠক আহ্বান করেন। ওই বৈঠকে উপদেষ্টা পরিষদের একাধিক সদস্য, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, সশস্ত্র বাহিনী এবং গোয়েন্দা সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
শুক্রবার রাতের সেই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী, তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, জ্বালানি উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান, স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান, সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমানসহ প্রধান উপদেষ্টার বিভিন্ন মন্ত্রণালয় বিষয়ক বিশেষ সহকারীরা। এ ছাড়া পুলিশ, সশস্ত্র বাহিনী ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও বৈঠকে অংশ নেন।
বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র ও সম্ভাব্য সংসদ প্রার্থী শরিফ ওসমান হাদির ওপর হামলাটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মেয়াদকালে সংঘটিত অন্যতম গুরুতর ও উদ্বেগজনক ঘটনা। তিনি বলেন, এ হামলা শুধু একজন ব্যক্তির ওপর নয়, বরং বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক অভিযাত্রার ওপর একটি সুপরিকল্পিত আঘাত। তার ভাষায়, “এই হামলার মাধ্যমে পরাজিত ও অপশক্তি দেশের অস্তিত্ব ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে চ্যালেঞ্জ করার দুঃসাহস দেখিয়েছে।”
প্রধান উপদেষ্টা আরও বলেন, “এই ধরনের সহিংসতা ও হামলার চেষ্টা যেকোনো মূল্যে ব্যর্থ করে দেওয়া হবে। জাতির ওপর অপশক্তির এ ধরনের আঘাত কোনোভাবেই বরদাশত করা হবে না।” তিনি জোর দিয়ে বলেন, এই হামলার উদ্দেশ্য জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোটকে বানচাল করা। তবে সরকার কোনো অবস্থাতেই এ ধরনের ষড়যন্ত্র সফল হতে দেবে না।
ড. ইউনূস বলেন, “আঘাত যাই আসুক, যত ঝড়-তুফানই আসুক না কেন, কোনো শক্তিই আগামী নির্বাচনকে বানচাল করতে পারবে না। আমরা দেশের আপামর জনগণকে সঙ্গে নিয়ে সম্মিলিত শক্তির মাধ্যমে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন নিশ্চিত করব।”
বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টার স্বাস্থ্য বিষয়ক বিশেষ সহকারী মো. সায়েদুর রহমান জানান, গুলিবিদ্ধ শরিফ ওসমান হাদির শারীরিক অবস্থা অত্যন্ত সংকটাপন্ন। পরিবারের সদস্যদের সম্মতিতে তাকে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়েছে এবং সেখানে তিনি নিবিড় পর্যবেক্ষণে রয়েছেন।
এ প্রসঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা সংশ্লিষ্ট আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কড়া নির্দেশ দিয়ে বলেন, “যে করেই হোক, দ্রুততম সময়ের মধ্যে হাদির ওপর হামলাকারী ও হামলার পরিকল্পনাকারীদের গ্রেপ্তার করতে হবে।” তিনি দেশবাসীর প্রতি শরিফ ওসমান হাদির দ্রুত সুস্থতার জন্য মহান আল্লাহর কাছে দোয়া করার আহ্বান জানান।
পুলিশের পক্ষ থেকে বৈঠকে জানানো হয়, হামলার স্থান থেকে সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়েছে এবং অন্যান্য আলামতও জব্দ করা হয়েছে। এসব তথ্যের ভিত্তিতে হামলাকারীদের শনাক্ত ও গ্রেপ্তারে অভিযান জোরদার করা হয়েছে।
তাৎক্ষণিকভাবে সীমান্ত এলাকায় নজরদারি ও নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ দেন প্রধান উপদেষ্টা, যাতে হামলাকারীরা কোনোভাবেই দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে না পারে। পাশাপাশি তিনি বলেন, জুলাই অভ্যুত্থানে সক্রিয়ভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন—এমন ব্যক্তিরা যারা বর্তমানে সম্ভাব্য টার্গেটে পরিণত হতে পারেন, তাদের নিরাপত্তার বিষয়টি বিশেষভাবে বিবেচনায় রাখতে হবে।
বৈঠকে আরও সিদ্ধান্ত হয়, নির্বাচনকালীন যেকোনো অপ্রীতিকর পরিস্থিতি দ্রুত মোকাবিলার জন্য আগামী কয়েক দিনের মধ্যেই একটি বিশেষ হটলাইন নম্বর চালু করা হবে। এ হটলাইনের মাধ্যমে সহিংসতা, হুমকি বা অনিয়মের তথ্য দ্রুত সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে পৌঁছানো যাবে।
এ ছাড়া অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার এবং সম্ভাব্য যেসব স্থানে অপরাধীরা আত্মগোপন করে থাকতে পারে, সেখানে বিশেষ অভিযান জোরদারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। প্রধান উপদেষ্টা জানান, উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে তিনি শিগগিরই রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রধান রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের সঙ্গে ধারাবাহিক আলোচনা করবেন।
এদিকে, ডিএমপির জনসংযোগ বিভাগের উপকমিশনার মুহাম্মদ তালেবুর রহমান জানান, শুক্রবার জুমার নামাজের পর দুপুর ২টা ২৫ মিনিটে রাজধানীর বিজয়নগর বক্স কালভার্ট এলাকায় শরিফ ওসমান হাদির ওপর হামলা চালানো হয়। মোটরসাইকেলে আসা দুর্বৃত্তরা তাকে লক্ষ্য করে গুলি চালিয়ে দ্রুত পালিয়ে যায়। তিনি জানান, তিনটি মোটরসাইকেলে করে হামলাকারীরা ঘটনাস্থলে আসে বলে প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে।
এই ঘটনার পর রাজধানীসহ দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে নিরাপত্তা, নির্বাচন ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া নিয়ে নতুন করে আলোচনা ও উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।